Thursday 16 June 2016

Samik presents ground report from the Death traps,called Tea Gardens!

Samik presents ground report from the 

Death traps,called Tea Gardens!
অ্যালকেমিস্ট কথাটা এসেছে প্রাচীন যুগের অ্যালকেমি থেকে, যার মানে ‘ধাতুকে বদলে দেওয়ার কৌশল’। নানা ধাতুকে পাল্টে সোনা বানিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল তারা। আর আমরা নতুন করে যে ‘অ্যালকেমিস্ট’কে চিনলাম, তারা দশ হাজার কোটির একটা কোম্পানি, নানা ব্যবসার সাথে তাদের হাতে রয়েছে দার্জিলিং পাহাড়ের চা বাগানও। আগে নাম ছিল টুব্রো, এখন অ্যালকেমিস্ট। চিটফান্ড নিয়ে হইচইয়ের বাজারে এদেরও নাম ভেসে বেড়াচ্ছিল। মালিকের নাম কে ডি সিং। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ।
দশ-বারো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে তিনটে চা বাগান রয়েছে অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের হাতে। একটা পেশক চা বাগান— তিস্তাবাজারের কাছে। আর বাকি দুটো সোনাদা পেরিয়ে রঙবুল থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে, প্রথমে কলেজভেলি, তারপর বালাসন নদীর এপার-ওপার মিলিয়ে ধোত্রে চা বাগান। মোট তিনটে চা বাগানের ২০৭৫ হেক্টর জুড়ে ছড়ানো ৭ টা ডিভিশনে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৫৪৪। তাছাড়া আরও হাজার তিনেক ঠিকা শ্রমিক কাজ করতেন এই বাগানগুলিতে।
বাগানগুলো খোলা। কিন্তু অস্থায়ী শ্রমিক তো ছেড়েই দিন, স্থায়ী শ্রমিকদের সিংহভাগও কাজ করছেন না এখন। বেতন পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। পাচ্ছেন না বেতনের অংশ হিসেবে প্রাপ্য আরও নানা দ্রব্যাদি ও সুযোগসুবিধা। গত বছর শারদোত্সবের সময় থেকে বোনাস নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছিল, তা বাড়তে বাড়তে এখন সমস্যা শিখরে এসে পৌঁছেছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রাপ্য আর্থিক বকেয়ার পরিমাণ ১.৭২ কোটি টাকা, যার সাথে ওষুধের বিল, জ্বালানী কাঠের পয়সা, ছাতা, চপ্পল ইত্যাদি এবং অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুইটির বকেয়া হিসেব ধরলে পরিমাণটা ৫ কোটিতে পৌঁছবে। কয়েক মাস আগে অব্দি ছিটেফোঁটা যা-ও বা টাকাপয়সা পাচ্ছিলেন শ্রমিকরা, বিগত দুই মাস সেসবও বন্ধ।
পাতা তুলতে যাচ্ছেন শ্রমিকরা, তবে সংখ্যায় খুব কম। ২৫-৩০ শতাংশ। অনেকেই রাস্তার কাজ, ১০০ দিনের কাজ, নদীতে পাথর ভাঙ্গার কাজ করে বা আরও নানাভাবে সংসার চালাচ্ছেন। দূরদেশে পাড়িও দিয়েছেন অনেকে।
সরকারের শ্রম দপ্তরের ডাকা ত্রিপাক্ষিক মিটিংগুলোতে দুই দফায় সমস্ত বকেয়া পরিশোধের সময়সীমা দু’-দুবার নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও মালিকপক্ষ সেসব পূরণ করেনি এবং ইদানিং মিটিংয়ে আসা বা শ্রম দপ্তরের আধিকারিকদের ফোন ধরাও বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রমিকরা জানেন না কোথায় গেলে সুরাহা হবে, আশ্চর্য যে শ্রম দপ্তরের আধিকারিকরাও তা’ জানেন না বলে শ্রমিকদের জানিয়ে দিয়েছেন!
শ্রমিকরা বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন, সেই সময় বকেয়া পাওয়ার কিছু প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন তাঁরা, তারপর নানা মহল থেকে চাপ আসায় ভোট বয়কট থেকে সরে আসতে হয়। এবং বকেয়া পাননি। নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণে যা-ই মেরুকরণ হোক, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ওপরমহলে যেমনই বিন্যাস থাকুক, বাগানস্তরে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমস্ত ইউনিয়ন সংযুক্তভাবে গড়ে তুলেছেন জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি। আন্দোলনের নানা কর্মসূচী চলছে অবিরাম আর চলছে শ্রমিকদের দিশাহীন দৌড়— কোথায় গেলে সমাধান হবে সেই পরশপাথরের খোঁজে!
অ্যালকেমিস্ট গ্রুপের চা বাগানগুলো থেকে অর্থোডক্স টি ও চায়না টি ধরণের চা পাতা জার্মানী, অস্ট্রিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও আমেরিকায় রপ্তানি হয় বলে তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। শীতকাল জুড়ে পাতা তোলা বন্ধ থাকার পর প্রথম যে চা পাতা ওঠে, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত, সেই ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সব থেকে বেশি। তারপর ১৫-২০ দিন পরে শুরু হয় সেকেন্ড ফ্লাশের পাতা তোলা। শ্রমিকরা ভাবছেন, ফার্স্ট ফ্লাশ তো গেছে, কম শ্রমিক এবং যত্নের অভাব ও কম বৃষ্টির ফলে পাতা কম উঠেছে। কিন্তু সেকেন্ড ফ্লাশে নিশ্চয়ই মনোযোগ দেবে মালিক! কিন্তু কই, তারও তো কোনও নামগন্ধ নেই।
চা শিল্প লোকসানে চলছে বলে মালিকরা যতই হল্লা করুন, বাস্তবতা সেটা নয়। ২৭৭ টা চা বাগানের মধ্যে হাতেগোনা কিছু বাগানই বন্ধ আছে। কিছু বাগান আবার ফিবছর বন্ধ হয় শীতের সময়ে, কেননা তখন পাতা থাকে না বলে মালিকদের অনেকে সেইসময়ের খরচা বাঁচিয়ে আরও মুনাফা খোঁজে। অন্যদিকে চলতে থাকে শ্রমিকদের প্রাপ্যগুলো না দেওয়া এবং বাগান রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে চূড়ান্ত অবহেলা। অ্যালকেমিস্টের বাগানগুলো তার স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আবার হাজির হল। গত বছর জুড়ে ডানকান-গোয়েঙ্কার বাগানগুলোর ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখেছি। দীর্ঘদিন ধরে সেগুলোতে অরাজকতা চালানোর পর গত বছরের এপ্রিল থেকে মালিকরা শ্রমিকদের পাওনাগন্ডা বন্ধ করে দেয়, বাগানগুলো ছেড়ে চলে যায় ম্যানেজাররা, কোনও লক আউটের নোটিস ছাড়াই! তারও অনেক পরে, শ্রমিকদের ঘাম-রক্তের সঙ্গে তিস্তা-তোর্সা-লিস-ঘিস দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যাওয়ার পর সরকার-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার একটুআধটু নড়াচড়া শুরু হয়। এখন কয়েকটা বাগান খুলেছে, যদিও তার বেশিরভাগে ফ্যাক্টরি খোলেনি, পাওনাগন্ডা নিয়ে টালবাহানা চলছে, আর সাতখানা তো এখনও বন্ধই। কেন্দ্রীয় সরকারের অধিগ্রহণ, হাইকোর্টের কেসকাছারি, সরকারের উদাসীনতা, বাগান খোলার নিভু নিভু আশা, বিনা চিকিত্সায় মৃত্যু, শিশুদের পড়াশোনা নিয়ে টেনশন, পানীয় জলের হাহাকার, রেশনবন্টন নিয়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, কাঁচা পাতা তোলা নিয়ে অরাজকতা আর অন্যদিকে আশা যে ভোটের পরে কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে— এই নিয়ে বেঁচে আছে ডুয়ার্সের তথাকথিত ‘ডানকান নগরী’র সাতটা চা বাগানের বাসিন্দারা।
আমরা অ্যালকেমিস্টের বাগানগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। ডানকানের বাগানগুলোর কথা চলে এলো মাঝখানে। কেন? বাগান বন্ধও নয়, অথচ শ্রমিকদের বেতন ও প্রাপ্য বন্ধ— এরকম খোলা-বন্ধের মাঝামাঝি মডেলটা যদি ডানকান থেকে শুরু করে অ্যালকেমিস্ট... এবং আরও অনেক মালিকরা মুনাফার উপায় হিসেবে নিতে শুরু করে, তাহলে তো সমূহ বিপদ! শ্রমিকরা না পাচ্ছেন বাগানের মজুরি ও সুযোগসুবিধা, না বন্ধ বাগানের জন্য বরাদ্দ ‘ফাউলাই’ ভাতা!
অ্যালকেমিস্ট-এর বাগানগুলোর ব্যাপারে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে আসছে যে— সমস্ত বাগানেই পুরনো গাছের (৫০ বছর হয়ে গেলে উত্পাদনশীলতা কমে যায়) সংখ্যা বেশি, সেগুলো তুলে ফেলে নতুন গাছ লাগানো, বাগানের শূন্যস্থানগুলো ভরানো, যথাযথ কীটনাশকের প্রয়োগ, জলসিঞ্চনের ব্যবস্থা— এই সবেরই করুণ অবস্থা। মোট ২০৭৫ হেক্টর জমির মধ্যে প্ল্যান্টেশন এরিয়া ৯৯৫.২৩ হেক্টর। আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টেশন হয়েছে ২০.৪৫ হেক্টরে, ইনফিলিং হয়েছে ২.২৭ হেক্টরে, ইরিগেশন ১৮০.০৭ হেক্টরে, ড্রেনেজ ব্যবস্থা আছে ১৫০ হেক্টরে। ফলে উত্পাদনশীলতার গড় নিতান্তই কম। পাহাড়ে গড় উত্পাদনশীলতা ৫০০ কেজি/হেক্টর হওয়ার কথা। কলেজভ্যালিতে ৫৪০ কেজি/হেক্টর হলেও ধোত্রেতে মাত্র ৪০৬ কেজি/হেক্টর, আর পেশকে তো আরও কম, ৩৩৫ কেজি/হেক্টর মাত্র। এই তথ্যগুলো তিন বছর আগের, সরকারী রিপোর্টেই প্রকাশিত। এর পরে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।
ধোত্রে বা কলেজভ্যালির বাগানের শ্রমিকরা কোনওকালে বাগান চলায় এরকম নিদারুণ খারাপ অবস্থা এসেছিল বলে মনে করতে পারেন না। কিন্তু উপরের পরিসংখ্যানের মধ্যে লুকিয়ে আছে আজকের পরিণতির গোপন রসায়ন। পেশক বাগান অবশ্য প্রায় এক দশক আগে পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছর বন্ধ ছিল। সেসময় বাগানের ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, গোডাউন— সব নিঃশেষ হয়ে যায়। এখন এখান থেকে সংগৃহীত পাতা যায় বহু রাস্তা পেরিয়ে ধোত্রে বাগানের তুমসুঙের ফ্যাক্টরিতে। তিনটে বাগানের একটাই ফ্যাক্টরি চালু রয়েছে, বেশিরভাগ চা গাছ একশো বছরের পুরনো, কীটনাশক প্রয়োগ হয়নি অন্ততঃ তিন বছর— এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে অ্যালকেমিস্টের বাগানগুলো।
বাগানের লভ্যাংশ অন্য ব্যবসায় ‘সাইফনিং’ করে, বাগানের কুমিরছানা দেখিয়ে নানারকম লোন আদায় করে, অকশন মার্কেটকে পাশ কাটিয়ে অন্য নানাভাবে চা পাতা বিক্রির কারবার চালিয়ে বাগানের আয়ব্যয়ের হিসাবে গরমিল করে এক অভূতপূর্ব লুঠতরাজ চালাচ্ছে চা বাগানের মালিকরা। উদার অর্থনীতি এদেশে চালু হওয়ার পর চা বাগানগুলোতে হু হু করে বেড়েছে ফড়ে মালিকের সংখ্যা, যারা বাগান কিনে তারপর বাগান ছিবড়ে করে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে চা বাগানের অসংগঠিত ক্ষেত্র হিসেবে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে নয়া বাগান ও বটলিফ কারখানার ব্যবস্থাপনা। চাষের জমি বদলে চা-বাগান আর বাইরে থেকে কেনা পাতা দিয়ে কারখানা চালিয়ে দায়হীন দেদার মুনাফার বন্দোবস্ত! ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের অভূতপূর্ব চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এই মডেলেরই এখন জয়জয়কার।
অন্যদিকে পুরনো এস্টেট বাগানগুলোতে বেড়ে চলেছে ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা, কমছে বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ও শ্রমিকখাতে ব্যয়। চা শিল্পের মত একটা সংগঠিত ক্ষেত্রে আজও চালু নেই ন্যুনতম বেতন! শ্রমিকদের প্রাপ্যের হিসেবে রেশন, চিকিত্সার সুবিধা, ছাতা, জুতো, কম্বল, জ্বালানী কাঠ, শিশুদের জন্য ক্রেশের সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও, সেসব না দেওয়ার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরকার চুপচাপ বসে দেখবে আইনের এই নিদারুণ লঙ্ঘন? শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখালে গেল গেল রব ওঠে, বাগানে কাজ করে পোষাচ্ছে না বলে শ্রমিকরা অন্য কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেলে ‘অ্যাবসেন্টিজম’-এর নিদারুণ সংকট চলছে বলে বুক চাপড়াতে থাকে মালিকরা— অথচ সরকার একটা যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা, মালিকী আইনলঙ্ঘনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে না?
কোনও এক প্রাচীন যুগে চা শ্রমিকদের ‘চিয়াকো বোটমা সুন ফ্ল্ছ’ (চায়ের গাছে সোনা ফলে) বলে দলে দলে নিয়ে আসা হয়েছিল দূরদেশ থেকে। সোনা বানানোর কারবারী অ্যালকেমিস্টরা সোনা নিষ্কাশন করে নিয়েছে শ্রমিকদের রক্ত-ঘাম আর বাগানের সবুজ পাতা থেকে। বাগানে পড়ে থেকেছে বঞ্চনা, কান্না আর হাহাকার।

No comments:

Post a Comment