Sunday, 7 August 2016

কবি প্রণাম:বাইরের জগতে কি ধরনের রবীন্দ্র পরিচিতি আমাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখবে! পলাশ বিশ্বাস




কবি প্রণাম:বাইরের জগতে কি ধরনের রবীন্দ্র পরিচিতি আমাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখবে!

পলাশ বিশ্বাস

Bidula Bal posted this photo as Ananya,Sabita di,Bharati, Munmun,r Bidula Bal sing to remember Rabindra Nath on his death anniversary,Baishe Shravan!

তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী ঈশ্বরকে পূজার কথা বলতেন। 

 সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

বাংলার বিশ্বজনীন ভাবমুর্তি প্রগতিশীল, জাতের তোয়াক্কা না করা সমাজের, কিন্তু বাস্তবে সর্বত্রই আধিপাত্যবাদের জয়জয়কার সমাজ. রাজনীতি, সংস্কৃতি, পেশা, বাণিজ্য, সবক্ষেত্রেই সংরক্ষনের বাইরে ও সংরক্ষনের ক্ষেত্রেও অস্পৃশ্যতা নির্মম বাস্তব রবীন্দ্র চর্চায় আধিপাত্যবাদের জয়গান তাই প্রমাণ করে

রবীন্দ্র নাথের পুজা প্রসন্গে আমরা সারা দেশে সবচেয়ে বেশী আবেগপ্রবণ জাতি আমরা আমাদের জীবন ও যৌবন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ভাবতেও পারি না অথচ রবীন্দ্রচর্চা আধিপাত্যের ঘেরাটোপের বাইরে অসম্ভব নিপীড়িত পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে যে রবীন্দ্রনাথ, তা আমরা বার বার ভুলে যাই

 ভারতবর্ষের মানূষের কাছে তাই সার্বজনীন রবীন্দ্র পরিচিতি প্রেম ও আধ্যাত্বের কবি হিসাবে চন্ডালিকা নৃত্য নাটিকার মন্চনে আমরা যত না উত্সাহী,এই রবীন্দ্র রচনার মুল স্বর অস্পৃশ্যতা ও আধিপাত্যবাদের বিরোধিতা নিরিখে রবীন্দ্র পরিচিতি স্থাপনায আমাদের অনীহা সে অপেক্ষা প্রবলতর 

 আমরা রথের রশি নিয়ে বিস্থারিত আলোচনা আজও করিনি রাশিযয়ার চিঠির তাত্পর্য্য বূঝতে উত্তর ভারতের ন্যায় সামাজিক বদলের প্রতীক্ষাই আসাদের ভবিতব্য

বাংলায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে ভগবানের আসনে বসিয়েছি রবীন্দ্র সন্গীত না জানা মেয়েকে আমরা বিবাহযোগ্যা মনে করতে পারি না পরিবর্তন যুগে জনপথে আমরা প্রতিনিয়ত রবীন্দ্র সহচর কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, আমরা ঠিক কতটা ববীন্দ্রনাথকে জানি এবং বাইরের জগতে কি ধরনের রবীন্দ্র পরিচিতি আমাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখবে

জমিদারের পূত্র, নোবেল পুরস্কারের আলোয় আলোকিত রবীন্দ্রনাথকেই জনসমক্ষে পেশ করায় আমাদের যারপর নাই উত্সাহএই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হবে, এমন আশা করাই বৃথা৤

আপনি নিশ্চই রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা গীতিনাট্যটি পড়েছেন? দেখেছেন সেখানে প্রকৃতি কী অবমাননাকর জীবন যাপন করে চলছে- ওকে ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছি/ ও যে চন্ডালীকার ঝি। এই হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। মানবতা বিরোধী।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নৃত্যনাট্য। এ আখ্যানে তিনি ধর্মের মধ্যে বৈষম্য, জাতপাতের ভেদ ও অস্পৃশ্যতার মতো বিষয়গুলো যে ঠুনকো, তা খুব সহজেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কবি চ-ীদাসের 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এই বাণীরই প্রতিধ্বনি উঠে এসেছে তার এই সৃষ্টিকর্মে। চ-ালিকায় তিনি অস্পৃশ্য শ্রেণীর নারীর প্রতীকী চরিত্রে প্রকৃতি নামের এক তরম্নণীকে তুলে ধরেছেন। যে অন্য জাতের কাছে অচ্ছুৎ। অস্পৃশ্য প্রকৃতি (চ-ালের কন্যা চ-ালিকা) ফুলওয়ালী, দইওয়ালা, চুড়ি বিক্রেতা দ্বারাও অবজ্ঞাত ও প্রত্যাখ্যাত। এভাবেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্য দিয়ে চলছিল প্রকৃতির জীবন। এমনি একদিন প্রকৃতি কুয়ো থেকে জল তোলার সময় তার সামনে এসে দাঁড়ালেন 'বৌদ্ধ ভিৰু আমার'। তখনই প্রকৃতির 'দগ্ধ কাননের' জীবনটা বাঁচবার একটা অর্থ খুঁজে পেল। বুদ্ধ-শিষ্য ও করম্নণামন্ত্রের অনুগামী আনন্দ প্রকৃতির হাতে জলপান করতে চাইলে সে তার অপারগতার কথা জানায়। উত্তরে আনন্দ বলে_ 'যে মানব আমি সে মানব তুমি, কন্যা যা তাপিত শ্রানত্মকে সি্নগ্ধ করে সেই তো পবিত্র জল'। এই বলে আনন্দ প্রকৃতির হাতে জলপান করে এবং তাকে আশীর্বাদ করে। আনন্দ প্রকৃতিকে সহসা দিয়েছিল মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর সম্মান। প্রকৃতির কথায়_ 'তিনি বলে গেলেন আমায়, নিজেরে নিন্দা করো না, মানবের বংশ তোমার, মানবের রক্ত তোমার নাড়ি'তে। এর পর থেকেই অস্পৃশ্য প্রকৃতি উঠে দাঁড়াবার বা ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি পেল আনন্দের কাছ থেকে।

ব্রাক্ষ্মণ্যধর্ম হল একটি অধর্ম বা অধার্মিকের ধর্ম(অস্পৃশ্যতা অধর্ম নয় কি?) বা আরো ব্যাপকভাবে... চতুর্বর্ণপ্রথা,জাতপাত,অস্পৃশ্যতা-এগুলো হিন্দুধর্মের বিষয় নয়,এগুলো ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের জিনিস।ব্রাক্ষ্মণ্যধর্ম ... বর্ণভেদ,জাতপাত,অস্পৃশ্যতা,সতীদাহপ্রথা,গুরুপ্রসাদী প্রথা ইত্যাদি অমানবিক, অশালীন প্রথাগুলি ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মেরই অবদান।

মনে রাখা উচিত, অস্পৃশ্যতা কিন্তু রবীন্দ্র পরিবারকেও রেহাই দেই নি৤ রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মহর্ষি অভিধায় ভূষিত করে। আমৃত্যু দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা। অস্পৃশ্যতাপ্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন।

আম্বেদকর সারাজীবন সামাজিক বৈষম্য এবং অস্পৃশ্যতা প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এসময় তিনি বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। আম্বেদকরকে ১৯৯০ সালে মরণোত্তর 'ভারত-রত্ন' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় , অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার
আহ্বান জানিয়ে গান্ধীজীর পরামর্শে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস শ্রী শ্রী গুরুচাদ ঠাকুরের কাছে পত্র
লিখেছিলেন । পত্রের উত্তরে গুরুচাদ ঠাকুর লিখেছিলেন , " আমার এ জাতি অনুন্নত ও
অশিক্ষিত , এরা স্বাধীনতা কি জিনিস তা বুঝে না , তাছাড়া আপনারা আমাদের অস্পৃশ্য মনে
করেন । তাই আপনাদের সঙ্গে একত্রে আন্দোলন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।

ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতের দাবিদার হয়েও ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বৈষম্যকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করে বিশ্বজনীন মানবাধিকারকে পদদলিত করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে জাতপাতভিত্তিক যে বৈষম্য নীতি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও সামাজিক প্রশ্রয়ে চলে আসছে, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল তাকে 'মানবাধিকাল লঙ্ঘন' হিসেবে চিহ্নিত করতে চলেছে। জেনেভাতে জাতিসংঘের যে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের যে অধিবেশন চলছে, তাতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হতে পারে। কিন্তু ভারত জাতপাতমূলক এ বৈষম্যকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে।

এদিকে ভারত জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্য ও অস্পৃশ্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। এ জন্য তারা এই ইস্যুটির আন্তর্জাতিকীকরণের ঘোরতর বিরোধী। ভঅরত চায় না সামাজিক এই ক্ষতটিকে আন্তর্জাতিক পাদপ্রদীপের আলোয় আনা হোক। বিশেষ করে ভারত গণতান্ত্রিক বিশ্বে নিজেকে 'বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ' হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাছাড়া ভারত বিশ্বশক্তি হিসেবেও গড়ে উঠতে তৎপর। কিন্তু ভারতে মানবাধিকারের মান খুবই নিম্নপর্যায়ে রয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের স্বীকৃতি এবং ধর্মীয়, সামাজিক বা শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে সকল ধর্ম, বর্ণ ও পেশার মানুষকে একই মানবিক অধিকার ও মর্যাদায় উন্নীত করা।

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে সমাজপতিদের বিধান অমান্য করে বিবাহ করায় একটি দম্পতি তাদের আক্রোশের হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রাম থেকে পালিয়ে দিল্লীতে আত্মগোপন করে আছেন। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ওই দম্পতিকে এক মাসের জন্য পাহারা দিচ্ছে। তবে রবিন্দর নামের পুরুষটি আশঙ্কা করছে, তারা গ্রামে ফিরলে কিংবা সমাজপতিদের লোকজন তাদের আওতায় পেলে তাদেরকে হত্যা করা হতে পারে। রবিন্দর সম্ভাব্য ঘাতকদের ভয়ে চাকরিস্থল থেকে পালিয়ে দিল্লীতে গোপন বাসায় অবস্থান করছেন। সমাজপতিদের দাবি, বরং রবিন্দর ও কনে শিল্পীর বিয়ে শাস্ত্রসম্মত নয়। দু'টি পরিবার আলাদা গ্রামের হলেও সমাজপতিরা বলছেন, তাদের উভয়ের মধ্যে বংশসূত্রের সম্পর্ক রয়েছে। রবিন্দর সমাজপতিদের তাড়া খেয়ে নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে নিজ গ্রাম থেকে বিয়ের পর পালিয়ে এসে প্রাণ রক্ষা করেছেন। ক্ষোভে, দুঃখে, অসহায়ত্বে দিশেহারা হয়ে রবিন্দর আত্মহত্যা করতে চেয়েও পারেনি।

ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রবিন্দরদের মতো অসম বিয়ে যারা করেন, তাদের বেঁচে থাকা কঠিন। অন্যদিকে উঁচুবর্ণের ছেলের সাথে নিচুবর্ণের মেয়ের বা নিচুবর্ণের ছেলের সাথে উঁচুবর্ণের মেয়ের বিয়েও ভারতে মেনে নেয়া হয় না। এ জন্য উভয়পক্ষ বা কোনো এক পক্ষকে চড়ামূল্য দিতে হয়। হিন্দুদের ব্রাহ্মণ্যবাদী কৌলিণ্য ও জাতপাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার এই মধ্যযুগীয় আচার আধুনিক যুগে চলতে পারে না। কিন্তু তারপরও একমাত্র ভারতেই জাতপাতের বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে পক্ষপাত ও প্রশ্রয় মানবতাকে লাঞ্ছিত করে চলেছে।

সমাজ, আইন, পুলিশ, প্রশাসন, রাষ্ট্র সবাই ভারতে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার পক্ষে অবস্থান নেয়। এমনকি নিম্নবর্ণের মানুষ বা হরিজন অস্পৃশ্যরা উঁচুবর্ণের মানুষের মন্দিরে পূজা করার অধিকার পায় না। নিম্নবর্ণের কোনো হিন্দু উচ্চ বর্ণের পানি তোলার কুয়ো স্পর্শ করলে তার বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই তুচ্ছ অপরাধে অচ্ছ্যুৎ হরিজনদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। যুগ যুগ ধরে এই নির্মম লোমহর্ষক অত্যাচার চলছে ভারতীয় সমাজে। সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় শাস্ত্রকারদের অনুমোদনে ভারতে মানবাধিকারের যে লঙ্ঘনের মহোৎসব চলছে, রাষ্ট্রীয় আইনে তার কোনো প্রতিকার নেই।

ভারতের সংবিধান প্রণেতা অম্বেদকর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণাশ্রয়ী জাতিভেদের শিকার হয়ে অতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি 'মহাত্মা' গান্ধী পর্যন্ত অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হননি। তিনি শেষ পর্যন্ত অস্পৃশ্যদের 'হরিজন' আখ্যা দিয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু ভারতের কোটি কোটি হরিজন আজও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার অধিকার অর্জন করতে পারেননি।

হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ জাতপাতের বৈষম্য ও নিষ্ঠুর নিপীড়নের পাশাপাশি ভারতে মুসলমানদেরও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবজ্ঞা, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার বানিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে। ভারতের উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলছে, 'হয় কুরআন ছাড়ো, নয় ভারত ছাড়ো'। উগ্রপন্থী হিন্দুরা মুসলমানদের স্বতন্ত্র ধর্ম-সংস্কৃতি পরিহার করে শুদ্ধচারী হয়ে ভারতীয় জাতীয়তার নামে হিন্দুত্বকে গ্রহণ করারও জন্য চাপ দিয়ে আসছে।

এদিকে ভারতের নিম্নশ্রেণীর হিন্দু জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু মুসলমানরা যে রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিকার, ভারত সরকারিভাবেই তা স্বীকার করে নিয়েছে। 'মন্ডল কমিশন' ও 'সাচার কমিশন' নামের দুই কমিশনের রিপোর্টে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের অনগ্রসরতা ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে তার প্রতিকারের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের পথেও অগ্রসর হিন্দুদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির বাধা প্রবল। ভারতে গণতন্ত্র ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুফল থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দু, সংখ্যালঘু মুসলমান ও হরিজনরা পায় না।


বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত তার জাতপাতের বৈষম্য নিরসনে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের প্রতি আস্থা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এক ভাষণে অস্পৃশ্যতাকে বর্ণবিদ্বেষের সাথে তুলনা করেছিলেন। জাতিসংঘের জাতপাত নিরসন সম্পর্কিত খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতপাতের যাঁতাকলে পড়ে সারা পৃথিবীতে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ বৈষম্যের শিকার। এ ধরনের বৈষম্যকে অদ্ভুতভাবে পবিত্রতা বলে মনে করা হয়। কিন্তু ভারত বর্ণশ্রেণী হিন্দুত্বের মূলভিত্তি অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বৈষম্যকে লালন করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।

জাতপাতের বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতা ও সহিংতার অন্ধ উন্মাদনা বহাল রেখেও ভারত কিভাবে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গর্ব করতে পারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। মানবাধিকারের নীতিমালা সব দেশের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে।

সামাজিক অস্পৃশ্যতা ও ঘৃণা: হরিজন, ঋষি, সাঁওতাল, সুইপার, বুনো, মুন্ডা, শব্দকর, রবিদাস প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কাছে আর্থিক দারিদ্র্যের চেয়ে মানবিক দারিদ্র্য অর্থাৎ অস্পৃশ্যতা এবং সামাজিক ঘৃণাই সবচেয়ে বড় দরিদ্র। এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সেলুন প্রভৃতিতে প্রবেশাধিকার নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেলেও মূলধারার ছেলেমেয়েরা তাদের সঙ্গে মেশে না, অবজ্ঞা করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্কুলের শিক্ষকেরাও তাদের প্রতি যথাযথ আচরণ করেন না। কর্মক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে না। সামাজিক অস্পৃশ্যতা ও ঘৃণাকে দুর করতে হলে মূলধারার জনগণের বা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। যাদের কথায় জনগণ উজ্জীবিত ও প্রভাবিত হয় সেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও সমাজকর্মীকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা নিজেরাই অস্পৃশ্যতা এবং ঘৃণা থেকে মুক্ত। 

 অস্পৃশ্যতা এবং সামাজিক ঘৃণার সঙ্গে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা যখন যোগ হয় তখন সে সমাজ বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তা এসব অবহেলিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য পরিস্িথতিকে আরও অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহায়তা এবং মূলধারার জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের সমাজ বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করার জন্য সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে।

পেশাচ্যুতি: নানা কারণে এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের নিজ নিজ পেশা থেকে অপসারিত হচ্ছে বা পেশায় প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। যেমন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে সুইপার পদের চাকরিগুলো হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত থাকলেও নানাভাবে মূলধারার মানুষ এসব পেশায় ঢুকে পড়ায় সুইপার বা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ কাজ-চাকরি পাচ্ছে না। মূল পেশার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা সামাজিক অস্পৃশ্যতা এবং ঘৃণার কারণে অন্য পেশায়ও প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। ফলে তাদের দারিদ্র্য পরিস্িথতির আরও অবনতি হচ্ছে।
ভুমিদখল: গ্রামের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের (যারা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় থাকে) দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিবারগুলো জোরপূর্বক কিংবা জাল দলিলের মাধ্যমে বা অন্যান্য পন্থায় জমি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা কোনো সরকারের আমলেই বন্ধ হয়নি। দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া, জমিজমার কাগজপত্র ভালোভাবে সংরক্ষণ না করা প্রভৃতি কারণে ভুমি আত্মসাৎকারীদের তৎপরতা বিগত বছরগুলোতে ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার পরিবার জমি হারিয়ে ইতিমধ্যেই ভুমিহীন হয়ে গেছে। অবিলম্বে এ প্রক্রিয়া বন্ধ করা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে জবরদখলকারীদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে তা এসব পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ভুমিবিষয়ক আইনকানুন এবং তথ্যাদি না জানাও জমি হারানোর আরেকটি কারণ। ভুমি আইন বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসুচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিবারগুলো সারা বছরই একধরনের নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে বসবাস করে। নারীরাই এই নিরাপত্তাহীনতার প্রধান শিকার হন। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের দ্বারা সম্"মহানিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করা, চুরি করাসহ নানা ধরনের মামলায় জড়িয়ে নিরাপত্তাহীন পরিস্িথতির সৃষ্টি করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে নিঃস্ব করার প্রক্রিয়া বন্ধে সরকারি সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।

তথ্যহীনতা: তথ্যহীনতা বা 'তথ্য দারিদ্র্য' এসব জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক দারিদ্র্য পরিস্িথতির অবনতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুচক হিসেবে কাজ করে। জমির মালিকানা রক্ষার জন্য কী কী কাগজপত্র সংরক্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কে তথ্য এবং এসব বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব দারিদ্র্যায়নের গতি বাড়িয়ে দেয়। সরকারি কোন অফিসে কী কী সার্ভিস ও সহায়তা পাওয়া যায় অনেক পরিবারই তা জানে না বা কীভাবে সে সার্ভিস পাওয়া যায় সে সম্পর্কে অবগত নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য, জ্ঞান ও প্রযুক্তিও তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগে এসব তথ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিবেশ বিপর্যয়: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা জাতিগোষ্ঠীগুলো বনভুমি, জলাভুমি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার উপযোগী করে বংশানুক্রমিকভাবে জীবন ধারণ করে আসছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে দখল করার মাধ্যমে বন ও জলাভুমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে নানাভাবে বিনষ্ট করা হয়েছে বা হচ্ছে। আর এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব জনগোষ্ঠী। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে উপকুল এলাকার অনেক জেলায়ই খাওয়ার পানির যে সংকট দেখা দিয়েছে, তারও প্রধান শিকার এসব জনগোষ্ঠী।

আইনি ও বিচারিক সহায়তা না পাওয়া: দেশের নাগরিকেরা বিশেষ করে বিভিন্ন অবহেলিত গোষ্ঠীর পরিবারগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কতটুকু আইনি ও বিচারিক সহায়তা পাচ্ছে তার ভিত্তিতে সুশাসনের পরিমাপ হওয়া প্রয়োজন। এই মাপকাঠিতে বিচার করলে বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্িথতি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের কাছে মোটেই সন্তোষজনক নয়। আইনি ও বিচারিক সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র ও সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় পরিষেবা না পাওয়া: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যরা রাষ্ট্রীয় পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। 


সোনা কান্তি বড়ুয়া, টরন্টো থেকে   

বাংলাদেশ এনলাইটেনমেন্টে একদা দক্ষিন এশিয়ায় ব্রাহ্মণ ব্যতীত সবাই বৌদ্ধ ছিলেন। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণ রাজা  পুষ্যমিত্র (খৃষ্ঠ পূর্ব ১ম শতাব্দী) সহ চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন জঙ্গীদের সাথে কূঠনীতি করে উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম এবং মন্দির ধ্বংস করেন।কথাশিল্পী শওকত আলীর লেখা "প্রদোষে প্রাকৃতজন " এবং "দুষ্কালের দিবানিশি" গ্রন্থদ্বয়ে দক্ষিন এশিয়ার হিন্দু শাসকগণ কর্তৃক বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। 

 সম্রাট আকবরের আমলে হিজরি সালকে  (চান্দ্র ক্যালেন্ডার) অনুসরন করে  জানা বঙ্গাব্দের  অজানা ইতিহাস আমরা  হিন্দু রাজনীতির (সৌর ক্যালেন্ডার) ঐতিহাসিক  ষড়যন্ত্রে ভুলে আছি। ১৪৩২ হিজরি ১৪১৮ বাংলা বা বঙ্গাব্দ হয় কি করে? যুজুর ভয়ে নৌকা পাহাড়ের উপর  দিয়ে চলে। আমরা আরব দেশে গিয়ে  আজ ১৪১৮ হিজরি সাল বলতে পারি না। এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যা দিয়ে বঙ্গাব্দের ইতিহাস রচিত  হ'লো অথচ আমাদের জাতীয় বিবেকের জবাবদিহিতার শক্তি  মরে ধর্ম নামক বিভিন্নভয়  ভীতির কবলে।  ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হিন্দুরাজনীতির খাঁচা ভাঙতে অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাংলার বৌদ্ধগণ ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন। যার ফলে পশ্চিম বাংলায় আজ ও বুদ্ধ পূর্ণিমায় সরকারি ছুটি নেই।

 বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা "চন্ডালিকা" শীর্ষক নৃত্যনাট্যে  বিশ্বমানবতার বানী অহিংসা পরম ধর্ম প্রচার করেছেন। হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্ঠান সহ সকল মানব সন্তান মিলে আমাদের মানবজাতি। রাজনীতি ও ধর্ম মানবাধিকারকে ধ্বংস করা অমানবিক অপরাধ বলে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়, "গোত্র দেবতা গর্তে পুরিয়া, / এশিয়া মিলাল শাক্যমুনি।" হিন্দু শাসকগণ বুদ্ধগয়ার মাধ্যমে রাজনীতির "ব্রহ্মজাল"  পেতে রেখেছে। এই চাণক্য রাজনীতির কূট কৌশলে ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজপাঠ। তাই জাতিভেদ প্রথার  ট্রাজেডিতে  "বৌদ্ধগণ" ভারতে হিন্দু রাজনীতির ক্রীতদাসে পরিনত হয়েছে। আজ বৌদ্ধধর্ম ভারতের গরীব আদিবাসীদের ও ডঃ  বি. আর. আম্ভেদকরের অনুসারীদের ধর্ম।

 বাংলাদেশে পালরাজত্বের পর  রাজা বল্লালসেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র আরবের শেখকে তোয়াজ করে "শেখ শুভোদয়া" রচনা করেছিলেন। তারপর বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশ আক্রমন করে তার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে বাংলার বৌদ্ধগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। ভারতবর্ষে স্বাধীন বৌদ্ধ জাতির অস্তিত্ব ধ্বংস করে পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মের জয়গান, "সারা জাঁহা সে আচ্ছা হে হিন্দুস্থান তোমারা," এবং পশ্চিমবঙ্গে "বুদ্ধ পূর্নিমার" কোন সরকারি ছুটি নেই। কোলকাতার বাঙালি লেখক ও পন্ডিতগণ বুদ্ধপূর্নিমা সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কিছুই বলছেন না। ভারতে পলিটিক্যাল হিন্দু শাসকগণের অত্যাচারে বৌদ্ধগণ চন্ডালে বা নীচ জাতিতে পরিনত হয়েছে। হিন্দুশাসকদের কাছে বৌদ্ধগণ হিন্দু রাজনীতির গোলাম। শান্তিকামী হিন্দু জনতা বৌদ্ধদের পরম বন্ধু, কিন্তু পলিটিক্যাল অত্যাচারী হিন্দু শাসকগণই অভিশপ্ত বৌদ্ধদের শত্র"।   
        ব্রাহ্মণ্যবাদের মাফিয়াচক্রে "ধর্মের অপব্যবহারে" লোভী ব্রাহ্মণ সহ শাসকগণ জাতিভেদ প্রথায় সনাতন ধর্মের মস্তক বিক্রয় করে গণতান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে করেছিলেন। অধ্যাপক হরলাল রায় তাঁর লেখা 'চর্যাগীতি' গ্রন্থের দশম পৃষ্ঠায় লিখেছেন, 'ধর্মকোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় পালি সাহিত্যের উৎপত্তি। হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারত হতে বিতারিত হয়েছিল। আশ্চর্য্যরে বিষয়, বৌদ্ধ ধর্ম তাঁর জন্মভূমি হতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। মুসলমান আক্রমণের বহু পূর্বেই আমরা সারা ভারতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পূনরুত্থান দেখতে পাই। সংস্কৃত ভাষা ও চর্চা চলেছে তখন পুরোদমে। তাঁরাই বিধান দিলেনঃ অষ্টাদশ পূরণানি রামস্যচরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। এভাবে যাঁরা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে আয়ত্ত করে নিজের কুক্ষিগত করেছিলেন। বিশেষতঃ  কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবিগণ নিস্তেজ হয়ে পড়েন এবং রিক্ত সর্বশান্ত হয়ে তাঁরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ হতে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।"

বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, চর্যাপদগুলো নিয়ে যখন আমরা আলোচনায় বসি তখন সাধারণতঃ একটা প্রশ্ন জাগে যে, বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন এ চর্যাপদগুলো নেপালে ও ভূটানে পাওয়া গেল কেন?  চর্যাকারদের জীবনী গ্রন্থগুলোই বা তিব্বতি ভাষায় লেখা কেন? এ সমস্ত সমস্যামূলক প্রশ্নের উত্তরদানে একটু আলোচনা দরকার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অনেক ভারতীয় লেখক ও পন্ডিত মনে করেন যে ভারতে বৌদ্ধ রাজাদের অহিংসা ও সন্ন্যাস নীতির কারণে ভারতীয় সামরিক শক্তির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কি সৈন্যদল ভারত ও বাংলা জয় করে নিল। যাঁরা ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের জিজ্ঞাস্যঃ পাঠান ও তুর্কি সৈন্যগণ কি শুধু বৌদ্ধ বিহার, বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্দির ধ্বংস করল? তাহলে পুরীর বৌদ্ধবিহারকে কারা হিন্দুর জগন্নাথ মন্দিরে দীক্ষা দিল?

 "চন্ডালিকা" বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রবি ঠাকুরের কুঠারাঘাত


চন্ডালিকা   


একদল ফুলওয়ালি চলেছে ফুল বিক্রি করতে

ফুলওয়ালির দল।
   নব বসন্তের দানের ডালি এনেছি তোদেরি দ্বারে,
                                      আয় আয় আয়,
                              পরিবি গলার হারে।
                       লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে--
                       বেণীর বাঁধনে রাখিবি বেঁধে,
                       অলকদোলায় দুলাবি তারে,
                                    আয় আয় আয়।
                             বনমাধুরী করিবি চুরি
                             আপন নবীন মাধুরীতে--
                       সোহিনী রাগিণী জাগাবে সে তোদের
                       দেহের বীণার তারে তারে,
                                    আয় আয় আয়॥
--


                       আমার মালার ফুলের দলে আছে লেখা
                                বসন্তের মন্ত্রলিপি।
                       এর মাধুর্যে আছে যৌবনের আমন্ত্রণ।
                       সাহানা রাগিণী এর
                              রাঙা রঙে রঞ্জিত,
                       মধুকরের ক্ষুধা অশ্রুত ছন্দে
                              গন্ধে তার গুঞ্জরে।
                   আন্‌ গো ডালা, গাঁথ্‌ গো মালা,
                   আন্‌ মাধবী মালতী অশোকমঞ্জরী,
                            আয় তোরা আয়।
                   আন্‌ করবী রঙ্গন কাঞ্চন রজনীগন্ধা
                              প্রফুল্ল মল্লিকা,
                            আয় তোরা আয়।
                   মালা পর্‌ গো মালা পর্‌ সুন্দরী,
                            ত্বরা কর্‌ গো ত্বরা কর্‌।
                   আজি পূর্ণিমা রাতে জাগিছে চন্দ্রমা,
                             বকুলকুঞ্জ
                   দক্ষিণবাতাসে দুলিছে কাঁপিছে
                             থরথর মৃদু মর্মরি।
                   নৃত্যপরা বনাঙ্গনা বনাঙ্গনে সঞ্চরে,
                   চঞ্চলিত চরণ ঘেরি মঞ্জীর তার গুঞ্জরে।
                   দিস নে মধুরাতি বৃথা বহিয়ে
                             উদাসিনী, হায় রে।
                   শুভলগন গেলে চলে ফিরে দেবে না ধরা,
                             সুধাপসরা
                   ধুলায় দেবে শূন্য করি,
                             শুকাবে বঞ্জুলমঞ্জরী।
                   চন্দ্রকরে অভিষিক্ত নিশীথে ঝিল্লিমুখর বনছায়ে
                   তন্দ্রাহারা পিক-বিরহকাকলি-কূজিত দক্ষিণবায়ে
                   মালঞ্চ মোর ভরল ফুলে ফুলে ফুলে গো,
                   কিংশুকশাখা চঞ্চল হল দুলে দুলে গো॥


দইওয়ালার প্রবেশ

দইওয়ালা।
          দই চাই গো, দই চাই, দই চাই গো?
                          শ্যামলী আমার গাই,
                          তুলনা তাহার নাই।
                   কঙ্কনানদীর ধারে
                   ভোরবেলা নিয়ে যাই তারে--
                   দূর্বাদলঘন মাঠে তারে
                            সারা বেলা চরাই, চরাই গো।
                   দেহখানি তার চিক্কণ কালো,
                   যত দেখি তত লাগে ভালো।
                          কাছে বসে যাই ব'কে,
                          উত্তর দেয় সে চোখে,
                   পিঠে মোর রাখে মাথা--
                   গায়ে তার হাত বুলাই, হাত বুলাই গো॥

মেয়ে।
        ওকে    ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
                ও যে    চণ্ডালিনীর ঝি--
                       নষ্ট হবে যে দই
                       সে কথা জানো না কি।

[ দইওয়ালার প্রস্থান

চুড়িওয়ালার প্রবেশ

চুড়িওয়ালা।
  ওগো      তোমরা যত পাড়ার মেয়ে,
                          এসো এসো দেখো চেয়ে,
                             এনেছি কাঁকনজোড়া
                             সোনালি তারে মোড়া।
                         আমার কথা শোনো,
                               হাতে লহ প'রে,
                             যারে রাখিতে চাহ ধ'রে
                             কাঁকন দুটি বেড়ি হয়ে
                                   বাঁধিবে মন তাহার--
                                      আমি দিলাম কয়ে॥

প্রকৃতি চুড়ি নিতে হাত বাড়াতেই

মেয়েরা।
                   ওকে    ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
                             ও যে চণ্ডালিনীর ঝি।

[ চুড়িওয়ালা প্রভৃতির প্রস্থান

প্রকৃতি।
        যে আমারে পাঠাল এই
                           অপমানের অন্ধকারে
          পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।
                কেন দিব ফুল, কেন দিব ফুল,
                            কেন দিব ফুল আমি তারে--
                      যে আমারে চিরজীবন
                                রেখে দিল এই ধিক্‌কারে।
          জানি না হায় রে   কী দুরাশায় রে
             পূজাদীপ জ্বালি মন্দিরদ্বারে।
                  আলো তার নিল হরিয়া
                       দেবতা ছলনা করিয়া,
                            আঁধারে রাখিল আমারে॥

পথ বেয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ

ভিক্ষুগণ।
            যো সন্নিসিন্নো
                        বরবোধিমূলে,
                  মারং সসেনং মহতিং বিজেত্বা
                  সম্বোধি মাগঞ্চি অনন্তঞ্‌ঞানে
                  লোকুত্তমা তং পণমামি বুদ্ধ।

[ প্রস্থান

প্রকৃতির মা মায়ার প্রবেশ

মা।
         কী যে ভাবিস তুই অন্যমনে
                             নিষ্কারণে--
                  বেলা বহে যায়, বেলা বহে যায় যে।
              রাজবাড়িতে ওই বাজে ঘণ্টা ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং,
                                    বেলা বহে যায়।
                         রৌদ্র হয়েছে অতি তিখনো
                         আঙিনা হয় নি যে নিকোনো,
                             তোলা হল না জল,
                             পাড়া হল না ফল,
                         কখন্‌ বা চুলো তুই ধরাবি।
                         কখন্‌ ছাগল তুই চরাবি।
                             ত্বরা কর্‌, ত্বরা কর্‌, ত্বরা কর্‌--
                             জল তুলে নিয়ে তুই চল্‌ ঘর।
                         রাজবাড়িতে ওই বাজে ঘণ্টা
                             ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং
                                   ওই যে বেলা বহে যায়।

প্রকৃতি।
               কাজ নেই, কাজ নেই মা,
                         কাজ নেই মোর ঘরকন্নায়।
                             যাক ভেসে যাক
                                      যাক ভেসে সব বন্যায়।
                              জন্ম কেন দিলি মোরে,
                              লাঞ্ছনা জীবন ভ'রে--
                         মা হয়ে আনিলি এই অভিশাপ!
                         কার কাছে বল্‌ করেছি কোন্‌ পাপ,
                    বিনা অপরাধে একি ঘোর অন্যায়॥

মা।
     থাক্‌ তবে থাক্‌ তুই পড়ে,
                         মিথ্যা কান্না কাঁদ্‌ তুই
                                 মিথ্যা দুঃখ গ'ড়ে॥

[ প্রস্থান

প্রকৃতির জল তোলা

বুদ্ধশিষ্য আনন্দের প্রবেশ

আনন্দ।
       জল দাও আমায় জল দাও,
                      রৌদ্র প্রখরতর, পথ সুদীর্ঘ,
                               আমায় জল দাও।
                        আমি তাপিত পিপাসিত,
                          আমায় জল দাও।
                              আমি শ্রান্ত,
                                   আমায় জল দাও।

প্রকৃতি।
      ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো মোরে--
                         আমি চণ্ডালের কন্যা,
                    মোর কূপের বারি অশুচি।
                তোমারে দেব জল হেন পুণ্যের আমি
                                    নহি অধিকারিণী,
                        আমি চণ্ডালের কন্যা।

আনন্দ।
     যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।
                   সেই বারি তীর্থবারি
                        যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে,
                   যাহা তাপিত শ্রান্তেরে স্নিগ্ধ ক'রে
                               সেই তো পবিত্র বারি।
                       জল দাও আমায় জল দাও।

জল দান

[ প্রস্থান

প্রকৃতি।
         শুধু একটি গণ্ডূষ জল,
           আহা নিলেন তাঁহার করপুটের কমলকলিকায়।
              আমার কূপ যে হল অকূল সমুদ্র--
          এই যে নাচে এই যে নাচে তরঙ্গ তাহার,
              আমার জীবন জুড়ে নাচে--
                            টলোমলো করে আমার প্রাণ,
                                    আমার জীবন জুড়ে নাচে।
                  ওগো কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী পরম মুক্তি!
                                    একটি গণ্ডূষ জল--
                  আমার জন্মজন্মান্তরের কালি ধুয়ে দিল গো
                                    শুধু একটি গণ্ডূষ জল॥

মেয়ে পুরুষের প্রবেশ

ফসল কাটার আহ্বান

                       মাটি তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে,
                                    আয় আয় আয়।
                       ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে--
                                    মরি    হায় হায় হায়।
                             হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে,
                             দিগ্‌ বধূরা ফসলখেতে,
                       রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে ধরার আঁচলে--
                                    মরি    হায় হায় হায়।
                       মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
                       ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো দুয়ার খোলো।
                             আলোর হাসি উঠল জেগে,
                             পাতায় পাতায় চমক লেগে
                       বনের খুশি ধরে না গো, ওই যে উথলে--
                                    মরি    হায় হায় হায়॥

প্রকৃতি।
             ওগো     ডেকো না মোরে ডেকো না।
                       আমার কাজভোলা মন, আছে দূরে কোন্‌--
                               করে স্বপনের সাধনা।
                          ধরা দেবে না অধরা ছায়া,
                          রচি গেছে মনে মোহিনী মায়া--
                               জানি না এ কী দেবতারি দয়া,
                               জানি না এ কী ছলনা।
                   আঁধার অঙ্গনে প্রদীপ জ্বালি নি,
                   দগ্ধ কাননের আমি যে মালিনী,
                   শূন্য হাতে আমি কাঙালিনী
                         করি নিশিদিন যাপনা।
                   যদি সে আসে তার চরণছায়ে
                   বেদনা আমার দিব বিছায়ে,
                   জানাব তাহারে অশ্রুসিক্ত
                   রিক্ত জীবনের কামনা॥

দ্বিতীয় দৃশ্য

অর্ঘ্য নিয়ে বৌদ্ধনারীদের মন্দিরে গমন

                    স্বর্ণবর্ণে সমুজ্জ্বল নব চম্পাদলে
                    বন্দিব শ্রীমুনীন্দ্রের পাদপদ্মতলে।
                    পুণ্যগন্ধে পূর্ণ বায়ু হল সুগন্ধিত,
                    পুষ্পমাল্যে করি তাঁর চরণ বন্দিত॥

[ প্রস্থান

প্রকৃতি।
         ফুল বলে, ধন্য আমি
                               ধন্য আমি মাটির 'পরে।
                   দেবতা ওগো, তোমার সেবা
                               আমার ঘরে।
                   জন্ম নিয়েছি ধূলিতে,
                   দয়া করে দাও ভুলিতে,
                               নাই ধূলি মোর অন্তরে।
                      নয়ন তোমার নত করো,
                      দলগুলি কাঁপে থরোথরো।
                               চরণপরশ দিয়ো দিয়ো,
                        ধূলির ধনকে করো স্বর্গীয়,
                                    ধরার প্রণাম আমি তোমার তরে॥

মা।
                 তুই অবাক ক'রে দিলি আমায় মেয়ে।
                              পুরাণে শুনি না কি তপ করেছেন উমা
                                    রোদের জ্বলনে,
                                           তোর কি হল তাই।

প্রকৃতি।
              হাঁ মা, আমি বসেছি তপের আসনে।

মা।
                    তোর সাধনা কাহার জন্যে।

প্রকৃতি।
              যে আমারে দিয়েছে ডাক,
                                বচনহারা আমাকে দিয়েছে বাক্‌।
                        যে আমারি জেনেছে নাম,
                               ওগো তারি নামখানি মোর হৃদয়ে থাক্‌।
                            আমি তারি বিচ্ছেদদহনে
                              তপ করি চিত্তের গহনে।
                        দুঃখের পাবকে হয়ে যায় শুদ্ধ
                              অন্তরে মলিন যাহা আছে রুদ্ধ,
                        অপমান-নাগিনীর খুলে যায় পাক॥

মা।
                 কিসের ডাক তোর কিসের ডাক।
                      কোন্ পাতালবাসী অপদেবতার ইশারা
                             তোকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে,
                                    আমি মন্ত্র প'ড়ে কাটাব তার মায়া।

প্রকৃতি।
            আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে--
                                          জল দাও, জল দাও।

মা।
                 পোড়া কপাল আমার!
                                   কে বলেছে তোকে "জল দাও'!
                         সে কি তোর আপন জাতের কেউ।

প্রকৃতি।
            হাঁ গো মা, সেই কথাই তো ব'লে গেলেন তিনি,
                            তিনি আমার আপন জাতের লোক।
                       আমি চণ্ডালী, সে যে মিথ্যা, সে যে মিথ্যা,
                             সে যে দারুণ মিথ্যা।
                      শ্রাবণের কালো যে মেঘ
                             তারে যদি নাম দাও "চণ্ডাল',
                      তা ব'লে কি জাত ঘুচিবে তার,
                             অশুচি হবে কি তার জল।
                      তিনি ব'লে গেলেন আমায়--
                             নিজেরে নিন্দা কোরো না,
                      মানবের বংশ তোমার,
                             মানবের রক্ত তোমার নাড়ীতে।
              ছি ছি মা, মিথ্যা নিন্দা রটাস নে নিজের,
                             সে-যে পাপ।
                      রাজার বংশে দাসী জন্মায় অসংখ্য,
                             আমি সে দাসী নই।
                      দ্বিজের বংশে চণ্ডাল কত আছে,
                             আমি নই চণ্ডালী।

মা।
                 কী কথা বলিস তুই,
                                      আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে।
                             তোর মুখে কে দিল এমন বাণী।
                      স্বপ্নে কি কেউ ভর করেছে তোকে
                                      তোর গতজন্মের সাথি।
                             আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে।

প্রকৃতি।
    এ নতুন জন্ম, নতুন জন্ম,
                            নতুন জন্ম আমার।
              সেদিন বাজল দুপুরের ঘণ্টা,
                             ঝাঁ ঝাঁ করে রোদ্‌দুর,
                   স্নান করাতেছিলেম কুয়োতলায়
                               মা-মরা বাছুরটিকে।
                         সামনে এসে দাঁড়ালেন
                                   বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার--
                              বললেন, জল দাও।
                        শিউরে উঠল দেহ আমার,
                                    চমকে উঠল প্রাণ।
                            বল্‌ দেখি মা,
                        সারা নগরে কি কোথাও নেই জল!
                 কেন এলেন আমার কুয়োর ধারে,
                        আমাকে দিলেন সহসা
                                মানুষের তৃষ্ণা-মেটানো সম্মান।
                                   --

                       বলে,   দাও জল, দাও জল।
             দেব আমি কে দিয়েছে হেন সম্বল।
                      কালো মেঘ-পানে চেয়ে
                          এল ধেয়ে
                                চাতক বিহ্বল--
                         বলে,   দাও জল।
                    ভূমিতলে হারা
                          উৎসের ধারা
                                অন্ধকারে
                                      কারাগারে।
                                কার সুগভীর বাণী
                                      দিল হানি
                                   কালো শিলাতল--
                                        বলে    দাও জল॥

মা।
                   বাছা, মন্ত্র করেছে কে তোকে,
                             তোর     পথ-চাওয়া মন টান দিয়েছে কে।

প্রকৃতি।
             সে যে পথিক আমার,
                             হৃদয়পথের পথিক আমার।
                       হায় রে আর সে তো এল না এল না,
                                এ পথে এল না,
                          আর সে যে চাইল না জল।
             আমার হৃদয় তাই হল মরুভূমি,
                                  শুকিয়ে গেল তার রস--
                             সে যে চাইল না জল।
--

                         চক্ষে আমার তৃষ্ণা,
                              তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
                         আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,
                              সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।
                         ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়,
                              মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়--
                                   অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে।
                         যে ফুল কানন করত আলো,
                                   কালো হয়ে সে শুকালো।
                               ঝরনারে কে দিল বাধা--
                                    নিষ্ঠুর পাষাণে বাঁধা
                                          দুঃখের শিখরচূড়ে॥

মা।
                 বাছা, সহজ ক'রে বল আমাকে
                                    মন কাকে তোর চায়।
                               বেছে নিস মনের মতন বর--
                                    রয়েছে তো অনেক আপন জন।
                                         আকাশের চাঁদের পানে
                                              হাত বাড়াস নে।

প্রকৃতি।
                   আমি চাই তাঁরে
                      আমারে দিলেন যিনি সেবিকার সম্মান,
                             ঝড়ে-পড়া ধুতরো ফুল
                      ধুলো হতে তুলে নিলেন যিনি দক্ষিণ করে।
                            ওগো প্রভু, ওগো প্রভু
                              সেই ফুলে মালা গাঁথো,
                                পরো পরো আপন গলায়,
                            ব্যর্থ হতে তারে দিয়ো না দিয়ো না।

রাজবাড়ির অনুচরের প্রবেশ

অনুচর।
         সাত দেশেতে খুঁজে খুঁজে গো
                                শেষকালে এই ঠাঁই
                            ভাগ্যে দেখা পেলেম রক্ষা তাই।

মা।
               কেন গো কী চাই।

অনুচর।
         রানীমার পোষা পাখি কোথায় উড়ে গেছে--
                            সেই নিদারুণ শোকে
                              ঘুম নেই তাঁর চোখে,
                                  ও চারণের বউ।
                        ফিরিয়ে এনে দিতেই হবে তোকে,
                                ও চারণের বউ।

মা।
               উড়োপাখি আসবে ফিরে
                                এমন কী গুণ জানি।

অনুচর।
         মিথ্যে ওজর শুনব না, শুনব না,
                          শুনবে না তোর রানী।
                   জাদু ক'রে মন্ত্র প'ড়ে ফিরে আনতেই হবে
                                খালাস পাবি তবে,
                                     ও চারণের বউ।

[ প্রস্থান

প্রকৃতি।
             ওগো মা, ওই কথাই তো ভালো।
                              মন্ত্র জানিস তুই,
                                মন্ত্র প'ড়ে
                                      দে তাঁকে তুই এনে।

মা।
                   ওরে সর্বনাশী, কী কথা তুই বলিস--
                                    আগুন নিয়ে খেলা!
                             শুনে বুক কেঁপে ওঠে,
                                        ভয়ে মরি।

প্রকৃতি।
             আমি ভয় করি নে মা,
                                ভয় করি নে।
                            ভয় করি মা, পাছে
             সাহস যায় নেমে,
                        পাছে নিজের আমি মূল্যে ভুলি।
                   এত বড়ো স্পর্ধা আমার,
                               এ কী আশ্চর্য!
                        এই আশ্চর্য সে'ই ঘটিয়েছে--
                            তারো বেশি ঘটবে না কি,
                   আসবে না আমার পাশে,
                             বসবে না আধো-আঁচলে?

মা।
            তাঁকে আনতে যদি পারি
                       মূল্য দিতে পারবি কি তুই তার।
                          জীবনে কিছুই যে তোর
                                  থাকবে না বাকি।

প্রকৃতি।
        না, কিছুই থাকবে না, কিছুই থাকবে না,
                          কিছুই না, কিছুই না।
                    যদি আমার সব মিটে যায়
                             সব মিটে যায়,
                    তবেই আমি বেঁচে যাব যে
                             চিরদিনের তরে
                    যখন কিছুই থাকবে না।
                  দেবার আমার আছে কিছু
                            এই কথাটাই যে
                 ভুলিয়ে রেখেছিল সবাই মিলে--
            আজ জেনেছি, আমি নই-যে অভাগিনী;
                 দেবই আমি, দেবই আমি, দেব,
                        উজাড় করে দেব আমারে।
                 কোনো ভয় আর নেই আমার।
                      পড়্‌ তোর মন্তর, পড়্‌ তোর মন্তর,
                ভিক্ষুরে নিয়ে আয় অমানিতার পাশে,
                          সে'ই তারে দিবে সম্মান--
                      এত মান আর কেউ দিতে কি পারে।

মা।
               বাছা, তুই যে আমার বুকচেরা ধন।
                             তোর কথাতেই চলেছি
                                      পাপের পথে, পাপীয়সী।
                             হে পবিত্র মহাপুরুষ,
                                      আমার অপরাধের শক্তি যত
                             ক্ষমার শক্তি তোমার
                                      আরো অনেক গুণে বড়ো।
                             তোমারে করিব অসম্মান--
                 তবু প্রণাম, তবু প্রণাম, তবু প্রণাম।

প্রকৃতি।
         আমায়     দোষী করো।
                             ধুলায়-পড়া ম্লান কুসুম
                                      পায়ের তলায় ধরো।
                             অপরাধে ভরা ডালি
                   নিজ হাতে করো খালি,
              তার পরে সেই শূন্য ডালায়
                 তোমার করুণা ভরো--
                        আমায় দোষী করো।
            তুমি উচ্চ, আমি তুচ্ছ
                      ধরব তোমায় ফাঁদে
                         আমার অপরাধে।
                    আমার দোষকে তোমার পুণ্য
                         করবে তো কলঙ্কশূন্য--
                    ক্ষমায় গেঁথে সকল ত্রুটি
                             গলায় তোমার পরো॥

মা।
        কী অসীম সাহস তোর, মেয়ে।

প্রকৃতি।
         আমার সাহস!
                      তাঁর সাহসের নাই তুলনা।
                 কেউ যে কথা বলতে পারে নি
              তিনি ব'লে দিলেন কত সহজে--
                            জল দাও।
         ওই একটু বাণী--
                                   তার দীপ্তি কত;
                        আলো ক'রে দিল আমার সারা জন্ম।
                   বুকের উপর কালো পাথর চাপা ছিল যে,
                               সেটাকে ঠেলে দিল--
                                    উথলি উঠল রসের ধারা।

মা।
                     ওরা কে যায়
                            পীতবসন-পরা সন্ন্যাসী।

বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল

ভিক্ষুগণ।
              নমো নমো বুদ্ধদিবাকরায়,
                         নমো নমো গোতমচন্দিমায়,
                              নমো নমো নন্তগুণণ্ণরায়,
                                   নমো নমো সাকিয়নন্দনায়।

প্রকৃতি।
            মা, ওই যে তিনি চলেছেন
                                    সবার আগে আগে!
                       ফিরে তাকালেন না, ফিরে তাকালেন না--
                                তাঁর নিজের হাতের এই নূতন সৃষ্টিরে
                                        আর দেখিলেন না চেয়ে!
                                এই মাটি, এই মাটি, এই মাটিই তোর
                                        আপন রে!
                          হতভাগিনী, কে তোরে আনিল আলোতে
                                         শুধু এক নিমেষের জন্যে!
                                থাকতে হবে তোকে মাটিতেই
                                      সবার পায়ের তলায়।

মা।
     ওরে বাছা, দেখতে পারি নে তোর দুঃখ--
                               আনবই আনবই, আনবই তারে
                                              মন্ত্র প'ড়ে।

প্রকৃতি।
                পড়্‌ তুই সব চেয়ে নিষ্ঠুর মন্ত্র,
পাকে পাকে দাগ দিয়ে
                             জড়ায়ে ধরুক ওর মনকে।
                        যেখানেই যাক,
                             কখনো এড়াতে আমাকে
                                   পারবে না, পারবে না।

আকর্ষণীমন্ত্রে যোগ দেবার জন্যে মা

তার শিষ্যাদলকে ডাক দিল

মা।
             আয় তোরা আয়,
                         আয় তোরা আয়।

তাদের প্রবেশ ও নৃত্য

                      যায় যদি যাক সাগরতীরে--
                         আবার আসুক, আসুক ফিরে।
                               রেখে দেব আসন পেতে
                                        হৃদয়েতে।
                               পথের ধুলো ভিজিয়ে দেব
                                        অশ্রুনীরে।
                               যায় যদি যাক শৈলশিরে--
                         আসুক ফিরে, আসুক ফিরে।
                                  লুকিয়ে রব গিরিগুহায়,
                                          ডাকব উহায়--
                                  আমার স্বপন ওর জাগরণ
                                          রইবে ঘিরে॥

মায়ের মায়ানৃত্য

মা।
                     ভাবনা করিস নে তুই--
                               এই দেখ্‌ মায়াদর্পণ আমার,
                                     হাতে নিয়ে নাচবি যখন
                     দেখতে পাবি তাঁর কী হল দশা।
                   এইবার এসো এসো রুদ্রভৈরবের সন্তান,
                              জাগাও তাণ্ডবনৃত্য।

[ প্রস্থান

তৃতীয় দৃশ্য

মায়ের মায়ানৃত্য

প্রকৃতি।
                  ওই দেখ্‌ পশ্চিমে মেঘ ঘনালো,
                                      মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে--
                                   উড়ে যাবে শুষ্ক সাধনা সন্ন্যাসীর
                                      শুকনো পাতার মতন।
                                   নিববে বাতি, পথ হবে অন্ধকার,
                                      ঝড়ে-বাসা-ভাঙা পাখি
                                   ঘুরে ঘুরে পড়বে এসে মোর দ্বারে।
                                      দুরু দুরু করে মোর বক্ষ,
                                   মনের মাঝে ঝিলিক দিতেছে বিজুলি।
                                   দূরে যেন ফেনিয়ে উঠেছে সমুদ্র--
                                      তল নেই, কূল নেই তার।
                                      মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে।

মা।
                       এইবার আয়নার সামনে নাচ্‌ দেখি তুই,
                                      দেখ্‌ দেখি কী ছায়া পড়ল।

প্রকৃতির নৃত্য

প্রকৃতি।
                  লজ্জা ছি ছি লজ্জা!
                              আকাশে তুলে দুই বাহু
                                        অভিশাপ দিচ্ছেন কাকে।
                                   নিজেরে মারছেন বহ্নির বেত্র,
                                      শেল বিঁধছেন যেন আপনার মর্মে।

মা।
                       ওরে বাছা, এখনি অধীর হলি যদি,
                                   শেষে তোর কী হবে দশা।

প্রকৃতি।
               আমি দেখব না, আমি দেখব না,
                               আমি দেখব না তোর দর্পণ।
                            বুক ফেটে যায়, যায় গো,
                                      বুক ফেটে যায়।
                            কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝঞ্ঝা--
                         মহান বনস্পতি ধুলায় কি লুটাবে,
                                    ভাঙবে কি অভ্রভেদী তার গৌরব।
                         দেখব না, আমি দেখব না তোর দর্পণ।
                                         না না না।

মা।
                         থাক্‌ তবে থাক্‌ এই মায়া।
                                   প্রাণপণে ফিরিয়ে আনব মোর মন্ত্র--
                                        নাড়ী যদি ছিঁড়ে যায় যাক,
                                   ফুরায়ে যায় যদি যাক নিশ্বাস।

প্রকৃতি।
                   সেই ভালো মা, সেই ভালো।
                                        থাক্‌ তোর মন্ত্র, থাক্‌ তোর--
                                   আর কাজ নাই, কাজ নাই ,কাজ নাই।
                             না না না, পড়্‌ মন্ত্র তুই, পড়্‌ তোর মন্ত্র--
                                        পথ তো আর নেই বাকি!
                                   আসবে সে, আসবে সে, আসবে,
                               আমার জীবনমৃত্যু-সীমানায় আসবে।
                                  নিবিড় রাত্রে এসে পৌঁছবে পান্থ,
                                    বুকের জ্বালা দিয়ে আমি
                                        জ্বালিয়ে দিব দীপখানি--
                                              সে আসবে।
                                     --

                               দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার।
                                           স্নান করাব অতল জলে
                                                 বিপুল বেদনার।
                               মোর সংসার দিব যে জ্বালি,
                             শোধন হবে এ মোহের কালি--
                                  মরণব্যথা দিব তোমার
                                        চরণে উপহার॥

মা।
                    বাছা, মোর মন্ত্র আর তো বাকি নেই,
                                   প্রাণ মোর এল কণ্ঠে।

প্রকৃতি।
              মা গো, এতদিনে মনে হচ্ছে যেন
                                   টলেছে আসন তাঁহার।
                              ওই আসছে, আসছে, আসছে।
                        যা বহু দূরে, যা লক্ষ যোজন দূরে,
                                  যা চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে,
                              ওই আসছে, আসছে, আসছে--
                                  কাঁপছে আমার বক্ষ ভূমিকম্পে।

মা।
                   বল্‌ দেখি বাছা, কী তুই দেখছিস আয়নায়।

প্রকৃতি।
             ঘন কালো মেঘ তাঁর পিছনে,
                                    চারি দিকে বিদ্যুৎ চমকে।
                            অঙ্গ ঘিরে ঘিরে তাঁর
                                        অগ্নির আবেষ্টন,
                                  যেন শিবের ক্রোধানলদীপ্তি।
                            তোর মন্ত্রবাণী ধরি কালীনাগিনীমূর্তি
                                  গর্জিছে বিষনিশ্বাসে,
                                      কলুষিত করে তাঁর পুণ্যশিখা।

আনন্দের ছায়া-অভিনয়

মা।
                   ওরে পাষাণী,
                        কী নিষ্ঠুর মন তোর,
                         কী কঠিন প্রাণ,
                        এখনো তো আছিস বেঁচে।

প্রকৃতি।
             ক্ষুধার্ত প্রেম তার নাই দয়া,
                                     তার নাই ভয়, নাই লজ্জা।
             নিষ্ঠুর পণ আমার,
                  আমি মানব না হার, মানব না হার--
                       বাঁধব তাঁরে মায়াবাঁধনে,
                             জড়াব আমারি হাসি-কাঁদনে।
                       ওই দেখ্‌, ওই নদী হয়েছেন পার--
                             একা চলেছেন ঘন বনের পথে।
                       যেন কিছু নাই তাঁর চোখের সম্মুখে--
                                  নাই সত্য, নাই মিথ্যা;
                                      নাই ভালো, নাই মন্দ।

মাকে নাড়া দিয়ে

                             দুর্বল হোস নে হোস নে,
                       এইবার পড়্‌ তোর শেষনাগমন্ত্র--
                             নাগপাশ-বন্ধনমন্ত্র।

মা।
       জাগে নি এখনো জাগে নি
                  রসাতলবাসিনী নাগিনী।
                       বাজ্‌ বাজ্‌ বাজ্‌ বাঁশি, বাজ্‌ রে
                              মহাভীমপাতালী রাগিণী,
                                    জেগে ওঠ্‌ মায়াকালী নাগিনী--
                               ওরে মোর মন্ত্রে কান দে--
                      টান দে, টান দে, টান দে, টান দে।
                             বিষগর্জনে ওকে ডাক দে--
                       পাক দে, পাক দে, পাক দে,পাক দে।
                                গহ্বর হতে তুই বার হ,
                                     সপ্তসমুদ্র পার হ।
                                          বেঁধে তারে আন্‌ রে--
                                      টান্‌ রে, টান্‌ রে, টান্‌ রে, টান্‌ রে।
                                   নাগিনী জাগল, জাগল, জাগল--
                                 পাক দিতে ওই লাগল, লাগল, লাগল--
                            মায়াটান ওই টানল, টানল, টানল।
                            বেঁধে আনল, বেঁধে আনল, বেঁধে আনল॥
                      এইবার নৃত্যে করো আহ্বান--
                               ধর্‌ তোরা গান।
                      আয় তোরা যোগ দিবি আয়
                               যোগিনীর দল।
                         আয় তোরা আয়,
                            আয় তোরা আয়,
                              আয় তোরা আয়।

সকলে।
          ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন,
                               তেমনি উঠে এসো এসো।
                   শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি,
                               তেমনি তুমি, এসো এসো।
                   ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি
                         যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ,
                   তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে,
                         এসো তুমি, এসো তুমি এসো এসো।
                   আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায়,
                         যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে
                              তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো।
                         সুদূর হিমগিরির শিখরে
                   মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ,
                   প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে
                         বন্যাধারা যেমন নেমে আসে--
                              তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো॥

মা।
               আর দেরি করিস নে, দেখ্‌ দর্পণ--
                         আমার শক্তি হল যে ক্ষয়।

প্রকৃতি।
         না, দেখব না আমি দেখব না,
                                   আমি শুনব--
                   মনের মধ্যে আমি শুনব,
                   ধ্যানের মধ্যে আমি শুনব,
                                   তাঁর চরণধ্বনি।
                       ওই দেখ্‌ এল ঝড়, এল ঝড়,
                                  তাঁর আগমনীর ওই ঝড়--
                            পৃথিবী কাঁপছে থরো থরো থরো থরো,
                                গুরু গুরু করে মোর বক্ষ।

মা।
               তোর অভিশাপ নিয়ে আসে
                                     হতভাগিনী।

প্রকৃতি।
               অভিশাপ নয় নয়,
                       অভিশাপ নয় নয়--
                   আনছে আমার জন্মান্তর,
                       মরণের সিংহদ্বার ওই খুলছে।
                             ভাঙল দ্বার,
                                   ভাঙল প্রাচীর,
                                         ভাঙল এ জন্মের মিথ্যা।
                         ওগো আমার সর্বনাশ,
                                        ওগো আমার সর্বস্ব,
                                          তুমি এসেছ
                                        আমার অপমানের চূড়ায়।
                         মোর অন্ধকারের ঊর্ধ্বে রাখো
                               তব চরণ জ্যোতির্ময়।

মা।
                 ও নিষ্ঠুর মেয়ে,
                          আর যে সহে না, সহে না, সহে না।

প্রকৃতি।
            ওমা, ওমা, ওমা,
                            ফিরিয়ে নে তোর মন্ত্র
                               এখনি এখনি এখনি।
                            ও রাক্ষুসী, কী করলি তুই,
                                    কী করলি তুই--
                            মরলি নে কেন পাপীয়সী।
                        কোথা আমার সেই দীপ্ত সমুজ্জ্বল
                                   শুভ্র সুনির্মল
                                সুদূর স্বর্গের আলো।
                        আহা কী ম্লান, কী ক্লান্ত--
                              আত্মপরাভব কী গভীর।
                                      যাক যাক যাক,
                                    সব যাক, সব যাক--
                             অপমান করিস নে বীরের,
                                    জয় হোক তাঁর,
                                        জয় হোক।

আনন্দের প্রবেশ

                        প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,
                              দিলে তার এত মূল্য,
                                     নিলে তার এত দুঃখ।
                        ক্ষমা করো, ক্ষমা করো--
                             মাটিতে টেনেছি তোমারে,
                                    এনেছি নীচে,
                             ধূলি হতে তুলি নাও আমায়
                                    তব পুণ্যলোকে।
                               ক্ষমা করো।
                            জয় হোক তোমার জয় হোক।

আনন্দ।
               কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী।

সকলে বুদ্ধকে প্রণাম

সকলে।
                  বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্ণবো,
                            যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর ঞানলোচনো
                            লোকস্‌স পাপুপকিলেসঘাতকো
                            বন্দামি বুদ্ধং অহমাদরেণ তং॥

No comments:

Post a Comment